১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাতবার জাতীয় শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি আসে ২০১২ সালে, যখন প্রবর্তিত হয় সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি। এটি মুখস্থনির্ভরতা কমিয়ে চিন্তাশক্তিকে গুরুত্ব দেয়। পরে ২০২১ সালে আরও বড় পরিবর্তন আনা হয়, যা ইতিবাচক হলেও দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় অনেকেই এটিকে বাস্তবসম্মত মনে করেননি। এমনকি সেই সময় নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনও হয়েছিল।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারও ২০১২ সালের আলোচিত সৃজনশীল পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা হয়। তবে সরকার ২০২৭ সাল থেকে একটি নতুন নৈতিক, মানবিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম চালুর পরিকল্পনা করছে। এ লক্ষ্যে বিশ্বের ১৬টি দেশের শিক্ষাক্রম বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
যেমন, অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি অঞ্চলভেদে ভিন্ন। সেখানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা, প্রযুক্তি, নীতি, সৃজনশীলতা, মানবিকতা, সমাজবিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। ধারাবাহিক মূল্যায়নেই বেশি জোর দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলগুলো নিজেরাই তাদের মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করে। শিক্ষকরা দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাদানে মনোযোগী, যার ফলে শিক্ষার্থীরা অনুসন্ধানভিত্তিক শিক্ষায় উৎসাহী হয়।
ফিনল্যান্ড, যাকে বিশ্বের অন্যতম সুখী দেশ হিসেবে ধরা হয়, সেখানে শিক্ষা হয় নীতি, গণিত, বিজ্ঞান, শিল্পকলাসহ বাস্তবমুখী বিষয়কেন্দ্রিক। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা জীবনঘনিষ্ঠ সমস্যার সমাধান শেখে। দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
চীন, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোর একটি, সেখানকার শিক্ষাক্রমে ভাষা, কারিগরি শিক্ষা, গণিত, নৈতিকতা ও রাজনৈতিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিকভাবে দলগত কাজ, সমস্যা সমাধান এবং উদ্ভাবনী চিন্তার ওপর মূল্যায়ন হয়।
তবে বাংলাদেশে এসব দেশের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য যে আর্থসামাজিক কাঠামো প্রয়োজন, তা এখনও গড়ে ওঠেনি। পাশাপাশি দক্ষ শিক্ষক ও প্রশিক্ষকেরও ঘাটতি রয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর বিশেষজ্ঞ ড. মুহাম্মদ জাইর আল ফারুকী বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত চর্চার ঘাটতি রয়েছে। এজন্য শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা ও নিষ্ঠা বাড়াতে হবে।
শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথে আরেকটি বড় বাধা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবির চৌধুরী জানিয়েছেন, এই বাধা অতিক্রমে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামো তৈরি করা হবে। দলগুলোর সম্মতিতেই এটি বাস্তবায়িত হবে।
শিক্ষাবিদদের মতে, বিশ্বের অনেক দেশ আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে প্রায় প্রতি বছরই শিক্ষাক্রমে সংশোধন আনে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান মনে করেন, শিক্ষাক্রম সংস্কারের আগে সংবিধানের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করা জরুরি। যদি তা না হয়, তাহলে বর্তমান সংবিধান বা একটি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে শিক্ষানীতি গঠন করতে হবে। কারণ পুরোনো শিক্ষানীতিতে নানা অসঙ্গতি ও ফাঁকফোকর রয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করা অনুচিত।
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, একবারেই পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, তবে একটি কাঠামো তৈরি করে এগিয়ে যাওয়া যায়। তিনি জানান, এনসিটিবিতে এ বিষয়ে একাধিকবার বৈঠকও হয়েছে এবং কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে সচেতন অভিভাবকরা মনে করেন, এমন শিক্ষাব্যবস্থা চাওয়া উচিত নয় যা নোটবই ও কোচিং নির্ভর হয়ে ওঠে এবং বাণিজ্যিকীকরণকে উৎসাহিত করে।
মন্তব্য করুন